বিদআত কি? ও বিদআত কারীর পরিণাম

বিদআত কি? ও বিদআত কারীর পরিণাম


বিদআত শব্দের আভিধানিক অর্থ = নতুন আবিষ্কার।
শরিয়াতের পরিভাষায় বিদআত হচ্ছে ধর্মের নামে নতুন কাজ, নতুন ইবাদাত আবিষ্কার করা।

নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, “যে ব্যক্তি এমন আমল করবে যার ব্যাপারে আমার শরীতের নির্দেশনা নেই, উহা প্রত্যাখ্যাত।” (মুসলিম হা/৩২৪৩)

তিনি আরো বলেন- " নিঃসন্দেহে সর্বোত্তম কথা হচ্ছে আল্লাহ্‌র কিতাব, সর্বোত্তম পদ্ধতি হচ্ছে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর পদ্ধতি। আর নিকৃষ্ট কাজ হচ্ছে শরীয়াতে নতুন কিছু সৃষ্টি করা, এবং প্রত্যেক বিদ'আত হচ্ছে ভ্রষ্টতা। (মুসলিমঃ ৭৬৮)

"রাসুল (সাঃ) আরো বলেছেন-যে আমার সুন্নাহ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে সে আমার দলভুক্ত নয়। [বুখারীঃ ৫০৬৩] অর্থাৎ যে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর পদ্ধতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে নতুন নতুন ইবাদাত আবিষ্কার করবে অথবা আল্লাহ্‌র নৈকট্যের জন্য নতুন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করবে সে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর পদ্ধতিকে তুচ্ছ মনে করল।

নিঃসন্দেহে রাসুল (সাঃ)-এর দেখিয়ে দেয়া পদ্ধতি-ই এবং ইবাদাত সমূহ-ই উত্তম হবে।

অতএব কেউ যদি আর রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর রাসুল (সাঃ)-এর দেখিয়ে দেয়া পদ্ধতি এবং ইবাদাত সমূহকে উত্তম মনে না করে, বর্তমান যুগের আলেমদের দেখিয়ে দেয়া পদ্ধতি এবং ইবাদাত সমূহকে উত্তম মনে করে তবে উপরের হাদিস অনুযায়ী সেই ব্যক্তি আর রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর উম্মত-ই থাকবে না।

এবার আসুন বিদআত সমূহ চিহ্নিত করার চেষ্টা করিঃ
দ্বীনের মধ্যে বিদআত মূলত দু’প্রকার।
(১) বিশ্বাসের ক্ষেত্রে বিদআত
(২) আমলের ক্ষেত্রে বিদআত।

বিশ্বাসের ক্ষেত্রে বিদআতঃ ইসলামের মূল ভিত্তি হচ্ছে ঈমান, তথা বিশ্বাস। যে যে বিষয়য়ের উপর বিশ্বাস স্থাপন করতে হয় সেই সব জিনিষের সাথে যদি আরো নতুন নতুন বিষয় বিশ্বাস করা হয় তবে সেটাই হবে বিশ্বাসের ক্ষেত্রে বিদআত। বিশ্বাসের ক্ষেত্রে বিদআত হচ্ছে ঐ সমস্ত বিদআত যে গুলো নাবী (সাঃ) ঈমান আনার জন্য বিশ্বাস করতে বলেন নি, যে সকল বিশ্বাস সাহাবায়ে কেরাম করতেন না। যেমনঃ আল্লাহ্‌ নিরাকার, আল্লাহ্‌ সর্বাস্থানে বিরাজমান, নাবী (সাঃ) নূরের তৈরী, নাবী (সাঃ)-কে সৃষ্টি না করলে কিছুই আল্লাহ্‌ সৃষ্টি করতেন না ইত্যাদি সব-ই বাতিল আকীদা সমূহ। এই ধরণের নতুন নতুন আকিদাই হচ্ছে- বিশ্বাসের ক্ষেত্রে বিদআত।

আমলের ক্ষেত্রে বিদআতঃ যেহেতু বিদআত মানেই হচ্ছে এই শরিয়াতে নতুন নতুন আবিষ্কার করা তাই আমলের ক্ষেত্রেও নাবী (সাঃ) যে সলক আমল করতে নির্দেশ দেননি, সাহাবায়ে কেরামগণ যে সকল আমল করেন নি বা করতেন না, বর্তমান যুগের সেই সমস্ত আমলই বিদআতের অন্তর্ভুক্ত। এটা আবার কয়েক প্রকার হয়ে থাকে।
যেমনঃ-
(১) নতুন কোন ইবাদত আবিষ্কার করা,
(২) শরীয়ত সম্মত ইবাদতের মধ্যে বৃদ্ধি করা,
(৩) যেকোন একটি ইবাদত রাসুল (সাঃ) এর পন্থায় আদায় না করে নতুন, বিদআতী নিয়মে পালন করা,
(৪) শরীয়ত সম্মত ইবাদতকে সময়ের সাথে সংশ্লিষ্ট করা, যা শরীয়তে নির্ধারিত নয়।

নতুন ইবাদত আবিষ্কার করা ইসলামী শরীয়তের সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কেননা মহান আল্লাহ্‌ বলেন- "আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পূর্নাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার অবদান সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম। (সুরা আল মাইদাঃ ৩)

মহান আল্লাহ্‌ বলেন- হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর, রাসূলের (সাঃ) আনুগত্য কর এবং নিজেদের কর্ম বিনষ্ট করো না। (সুরা মুহাম্মাদঃ ৩৩)

মহান আল্লাহ্‌ আরো বলেন- "মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহ ও রসূলের চেয়ে আগে বাড়িও না এবং আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ সবকিছু শুনেন ও জানেন। (সুরা হুজুরাতঃ ১)

নাবী (সাঃ) বলেন- “যে ব্যক্তি এমন আমল করবে যার ব্যাপারে আমার শরীতের নির্দেশনা নেই, উহা প্রত্যাখ্যাত।” (মুসলিম হা/৩২৪৩)

তাই আমাদেরকে রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর পদ্ধতিতেই ফিরে আসতে হবে, উনার পদ্ধতিই যে আলেমের চেয়ে সর্বশ্রেষ্ঠ। মহান আল্লাহ্‌ বলেন- "যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্যে রসূলুল্লাহর মধ্যে উত্তম নমুনা রয়েছে। (সুরা আল আহযাবঃ ২১)

উল্লেখ্য যে, বিদআত হচ্ছে সেটাই যেটাকে দ্বীনের অংশ মনে করে করা হয় এবং নেকীর আশায় করা হয়।

দ্বীনের মধ্যে বিদআতের বিধানঃ দ্বীনের ব্যাপারে সকল প্রকার বিদআতই হারাম ও গোমরাহী। কেননা রাসূল (সাঃ) বলেছেন, وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الْأُمُورِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلَالَة

অর্থঃ তোমরা দ্বীনের মাঝে নতুন বিষয় আবিষ্কার করা থেকে বিরত থাকবে, কেননা প্রত্যেক নতুন বিষয়ই বিদআত। আর প্রতিটি বিদআতের পরিণাম গোমরাহী বা ভ্রষ্টতা।

উপরের হাদীছগুলোর মাধ্যমে এটাই প্রমাণিত হয় যে, দ্বীনের মধ্যে প্রতিটি নতুন বিষয়ই বিদআত। আর প্রতিটি বিদআতই হারাম ও গোমরাহী। তবে এ হারাম বিদআতের প্রকারভেদ অনুযায়ী বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। বিদআতের কিছু কিছু প্রকার প্রকাশ্য কুফরীরই নামান্তর। যেমন কবরবাসীদের নৈকট্য হাসিলের উদ্দেশ্যে কবরের চতুর্দিকে কাবা ঘরের তাওয়াফের ন্যায় তাওয়াফ করা, কবরের উদ্দেশ্যে পশু যবাই করা, নযর-মান্নত পেশ করা, কবরবাসীর কাছে দু’আ করা, তাদের কাছে আশ্রয় চাওয়া ইত্যাদি। এমন কিছু বিদআতও রয়েছে, যা শির্ক না হলেও মানুষকে শির্কের দিকে নিয়ে যায়। যেমন কবরের উপর গম্বুজ তৈরী করা, কবর উঁচু করা, পাকা করা, কবরের উপর লিখা, কবরের কাছে নামায আদায় করা, দু’আ করা ইত্যাদি।

একটি সতর্কতাঃ আমাদের দেশের কিছু কিছু বিদআতি আলেম বিদআতকে জায়েজ করার জন্য বিদাতে হাসানা এবং বিদাতে সাইয়েআ এদু’ভাগে ভাগ করে থাকে। বিদআতকে এভাবে ভাগ করা সম্পূর্ণ ভুল এবং রাসূল (সাঃ)এর হাদীছের সম্পূর্ণ বিপরীত। রাসূল (সাঃ) বলেছেন, প্রতিটি বিদআতই গোমরাহী বা ভ্রষ্টতা। আর এই শ্রেণীর আলেমগণ বলে থাকে, প্রত্যেক বিদআত গোমরাহী নয়। বরং এমন কিছু বিদআত রয়েছে, যা হাসানা বা উত্তম বিদআত।

আল্লাহ্‌র রাসুল (সাঃ) বলছেন- “প্রত্যেক বিদআতই গোমরাহী”

দুনিয়ার ক্ষেত্রে যদি কেউ নতুন কোন কাজ করে যা রাসুল (সাঃ) এর যুগে ছিল না সেটি শাব্দিক অর্থে বিদআত হলেও শরিয়াতগত পরিভাষায় নয়। যেমন রাসুল (সাঃ) মোবাইল ব্যাবহার করেন নি, তাহলে কি মোবাইল ব্যাবহার করা বিদআত? রাসুল (সাঃ) উটে ছড়েছেন, কিন্তু আমরা বাস, ট্রেন, বিমান ইত্যাদিতে চড়ি তাহলে কি এগুলোতে চড়া কি বিদআত?

-জী না এগুলো বিদআত নয়। কেননা বিদআত হচ্ছে সেটাই যেটাকে দ্বীনের অংশ মনে করে করা হয় এবং নেকীর আশায় করা হয়। দুনিয়া এবং দ্বীন ভিন্ন জিনিষ। দুনিয়ার ক্ষেত্রে কেউ নতুন নতুন জিনিষ আবিষ্কার করলে বা ব্যাবহার করলে সেটা শাব্দিক অর্থে বিদআত হলেও শরিয়াতগত পরিভাষায় বিদআত নয়। কেননা রাসুল (সাঃ) বলেছেন- নিকৃষ্ট কাজ হচ্ছে শরীয়াতে নতুন কিছু সৃষ্টি করা। (মুসলিমঃ ৭৬৮)

বিদআতের কু প্রভাবঃ
১. সবচেয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে- বিদআতি ব্যক্তির তওবা নসীব হয় না, কেননা সে তো এটা নেকি মনে করে করছে। চোরের মনে এক সময় অনুশোচনা আসে, মদখরের মনে এক সময় অনুশোচনা আসে কিন্তু বিদআতি ব্যক্তির মনে অনুশোচনা আসে না।

২. বিদ’আত ইসলামী লোকদের মাঝে দুশমনী , ঘৃণা , বিভেদ ও বিভক্তি সৃষ্টি করে। মহান আল্লাহ্‌ বলেন : “নিশ্চয় এটিই আমার সোজা সরল পথ তোমরা তারই অনুসরণ কর , তোমরা বহু পথের অনুসরণ করো না , কারণ তা তোমাদেরকে তাঁর এক পথ হতে বিচ্ছিন্ন করে দিবে” – সূরা আন’আম : ১৫৩ ।

৩. বিদ’আত সহীহ সুন্নাহকে বিতাড়িত করে তার স্থলাভিষিক্ত হয়। বাস্তব নমুনায় এর বিরাট প্রমাণ রয়েছে। যেমন ফরজ সালাত শেষে কিছু সুন্নাতি যিকর, দুয়া রয়েছে। কিন্তু জামা’বদ্ধ হয়ে হাত তুলে দো’আ করলে , সালাতের পরে পঠিতব্য সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত দো’আ ও যিকিরগুলো পড়া হয় না । অতএব বিদআত করলে সহীহ সুন্নাহ বিতাড়িত হবেই।

৪. যারা বিদআত করে তারা সর্বদা আল্লাহ্‌ থেকে গাফেল থাকে এবং জান্নাতের জন্য শর্টকাট খুঁজে। যেমন, যারা নিয়মিত ৫ ওয়াক্ত সালাত আদায় করে না তারা জুম্মার দিনে মুনাজাত দ্বারা পার পেতে চায়। যারা সারা বছর ফরজ ইবাদাত করে না, তারা শব-ই-বরাতের মত বিদআত তৈরি করে শর্টকাটে জান্নাত পেতে চায়।

৫. সুন্নাতকে ঘৃণা করে বিদআত করলে ফিতনায় পরে যাওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। মহান আল্লাহ্‌ বলেন- “যারা রাসুলের নির্দেশের বিরোধীতা করবে তারা যেন সতর্ক হয় তাদেরকে ফিতনা পেয়ে বসবে বা তাদেরকে পীড়াদায়ক শাস্তি দ্বারা গ্রাস করা হবে।” (সূরা আন-নূর : ৬৩)

৬. যারা সহিহ সুন্নাহর উপর আমল করে তাদেরকে বিদআতিরা গালি-গালাজ করে।

বিদআতের পরিনামঃ
উপরোক্ত আলচনায় এটা স্পষ্ট যে, বিদআত করা সম্পূর্ণ হারাম। বিদআতের পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ। বিদআত করলে ইবাদাত কবুল হয় না। বিদআতের শেষ পরিণাম জাহান্নাম।

বিদআত করলে কিয়ামতের দিন যখন সূর্য মাথা অতি নিকটে থাকবে তখন সকলে তৃষ্ণায় পানি পান করতে চাইবে, আর তখন রাসুলুল্লাহ (সাঃ) তার উম্মতকে হাউজে কাউসার থেকে পানি পান করাবেন। কিন্তু আফসোস বিদআতিরা সেই দিন পানি পান করতে পারবে না।

আবু হাসেম হতে বর্ণিত , তিনি বলেন আমি সাহালকে বলতে শুনেছি তিনি রাসূল (সাঃ) কে বলতে শুনেছেন , “আমি তোমাদের পূর্বেই হাওযে কাওসারের নিকট পৌঁছে যাব । যে ব্যক্তি সেখানে নামবে এবং তার পানি পান করবে সে আর কখনও পিপাসিত হবে না । কতিপয় লোক আমার নিকট আসতে চাইবে , আমি তাদেরকে চিনি আর তারাও আমাকে চেনে । অতঃপর আমার ও তাদের মধ্যে পর্দা পড়ে যাবে । রাসূল (সাঃ) বলবেন : তারা তো আমার উম্মাতের অন্তর্ভুক্ত । তাকে বলা হবে আপনি জানেন না আপনার পরে তারা কি আমল করেছে । তখন যে ব্যক্তি আমার পরে (দ্বীনকে) পরিবর্তন করেছে তাকে আমি বলবো : দূর হয়ে যা , দূর হয়ে যা” (সহীহ মুসলিম হা/৪২৪৩)।

বিদআতের কারনে জাহান্নাম অবধারিত- রাসূল (সাঃ) বলেছেন : ‘সব বিদ’আতই ভ্রষ্টতা, আর প্রত্যেক ভ্রষ্টতার পরিনাম-ই হচ্ছে জাহান্নাম। (আবু দাউদ)
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন